সিরিয়াস!!! (গল্প)
**********************
সবকিছুকে এত সিরিয়াসলি নেও কেন? এই যে আমাকে দেখো আমি কোনো কিছু নিয়েই এত সিরিয়াস হই না।
ইমনকে মনোবল দিতে দিতে বলছিল প্রিয়তী। ওরা দুজন ভালো বন্ধু। একেই পাড়ায় থাকে। একসাথে বড় হওয়া একসাথে স্কুলে যাওয়া বন্ধুত্ব নয় যেন একে অপরের ছায়া।
ইমন এমনিতে যত সিরিয়াসই হোক না কেন লোকের কথায় সে কান পাতে না। কান পেতে যে লোকগুলোর কথা শুনা যায় সে লোকগুলোর কর্মই অকর্মন্যতা। সে বিশ্বাস করে জগতের সব লোক ভালোর জন্য বলে না, কিছু লোক নিন্দা করার জন্য বলে। ওরা খেয়ে দেয়ে প্রভুর নিকট থেকে একটা জিনিস চেয়ে এনেছে সেটা হলো নিন্দা করা। প্রিয়তীকে নিয়েও তো কত লোকে কত কথা বলেছে। কত বাজে মন্তব্য করেছে। ইমন আর প্রিয়ন্তীকে শুনতে হয়েছে কড়া শাসনের বাণী। অথচ ইমন আর প্রিয়ন্তী জানে আর জানে জোড়া শালিকের মালিক, যে প্রিয়ন্তী আর ইমন কতখানি পবিত্র।

শৈশব থেকে কৈশোরে আশা দুটি বিপরীত লিঙ্গ তখন পর্যন্ত তাদের আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সমাজ তাদেরকে শিখিয়ে দেয়। তুমি মেয়ে ও ছেলে যদি এটা করে বসে ওটা করে বসে, কিংবা ও মেয়ে তুমি ছেলে যদি এটা হয়ে যায় কিংবা ওটা হয়ে যায় এমনি ভাবে দুজনের গোপন পরিচয় তুলে ধরা হয় তাদের সামনে। জ্ঞানীরা সমাজ গড়েছে কল্যাণে। আর মুর্খরা সমাজের নাম ব্যবহার করছে অকল্যাণে। তবে সমাজ যায় ভাবুক প্রিয়ন্তী আর ইমন কখনো তা ভাবে না। ওরা বন্ধু। জনম জনমের বন্ধু। হুমায়ুন আহমেদের সেই বিখ্যাত কথার মার পেঁচে তারা পড়েনি। ইমন প্রিয়ন্তীকে চাঁদ বলেই জানে।আর প্রিয়ন্তী ইমনকে সুর্য বলেই জানে। জগৎ যেখানে মিলন দেখে সেখানে ইমন প্রিয়ন্তীর কোনো সাক্ষাতই নাই।
সেদিন ইমন খুব ব্যথিত ছিলো। অকালে হাওরে পানি এসে হাওরের সব ফসল তলিয়ে দিয়েছিলো। খবর টা সে টিভিতে শুনেছে। তাই শুনে ওর চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না। না জানি মানুষ জন কিভাবে বেঁচে আছে। মানুষের কথা ভাবতে ভাবতে ওর চোখ অশ্রু টলটল হয়ে যায়। ওর চোখ দেখে প্রিয়ন্তী হাসে।ছেলে মানুষের কান্না একটা বেমানান বিষয়। তবুও কাঁদে। সাতার না জানা ইমন ভাবে গ্রামে এত পানিতে মানুষ বাঁচে কি করে? আমিতো ভয়েই শেষ হয়ে যেতাম। ও দেখেছে মানুষের সপ্ন ভেসে যাচ্ছে পানির সাথে। সেদিন ও এজন্য ব্যতীত ছিলো। ইমনের এমন মলিন মুখ দেখে প্রিয়ন্তীর অসহ্য লাগছিলো। শহরের ছেলে হাওরের কথা ভেবে এমন মলিন মুখে থাকবে কেন? তাই প্রিয়ন্তী রাগ করে বলছিলো সবকিছু সিরিয়াস নেও কেন?
সেদিনের কথাটি কেন যেন ইমনের মনে গেঁথে গেল?
তারপর থেকে আর সে সিরিয়াস হতে পারে না। কারণে অকারণে হাসে। প্রিয়ন্তীর পড়া মন্ত্রে ইমন সিরিয়াসকে গুলিয়ে ফেলেছে। সেদিন থেকে হাসিটা সুখে দুঃখে তার সাথী হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। প্রিয়ন্তী আর ইমন তখন কলেজে পড়ে। একদিন হঠাৎ প্রিয়ন্তী ইমনের পেন্টের পকেটে কিছু টাকা রেখে দিলো। আর কানে কানে বলল এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই, ওটা এমনিই। ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রীরা সেদিন ইমনের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো। ইমন বুঝতে পারেনি প্রিয়ন্তীর চালাকিটা। ক্লাসের কয়েকটা ছেলে প্রিয়ন্তীকে ডিস্টার্ব করা শুরু করেছিল।তাদেরকে কিছু একটা বোঝানোর জন্য প্রিয়ন্তী সেদিন ইমনের সাথে এই কান্ডটা করেছিল। ইমন শুধু সিরিয়াসের মন্ত্রটা শুনে মুচকি হেসেছিলো। সেদিন ক্লাসে শুধু ইমন প্রিয়ন্তীকে নিয়ে চলছিলো কানাকানি। কারো ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সেদিন আসল রহস্য অনুমান করতে পারেনি।
একদিন প্রিয়ন্তী এসে বললো ইমন খুব টেনশনে আছি। কি করব ভাবতে পারছি না।
ইমন তখন বলল এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?
প্রিয়ন্তী তখন বলল বাবার বন্ধু এসেছিল উনার ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথা বলতে।
ইমন তখন বলল এটা তো খুশির কথা।
প্রিয়ন্তীর কাছে ইমনের রিপ্লেটা ভালো লাগলো না। সে মনে করেছিল বন্ধ রুমে একাকিত্বের চাদর জড়িয়ে যেমন ইমনকে হারানোর ভয় অনুভব করেছিলো।ইমনও তেমনি তাকে একা হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে কষ্ট পাবে। কিন্তু ইমন এই সিরিয়াস মুহূর্তটা সিরিয়াসলি নেই নি। তাই অভিমান করে প্রিয়ন্তী ইমনের সামনে থেকে চলে গেল। ইমনকে এই প্রথম বার একাকিত্বের বিষে দংশিল।
প্রিয়ন্তীকে হারানোর ভয় তাকে আন্দোলিত করলো।
তবে কি ইমন প্রিয়ন্তীকে ভালোবাসে?
জগতের প্রতিটি হৃদয় ভালোবাসে। প্রেমে পাপ থাকতে পারে ভালোবাসায় নেই। ভালোবাসা নির্মল পবিত্র এক আবেগের নাম।
তবু সেদিন ইমন সমাজ নিয়ে ভেবেছিলো। এক মুহুর্ত আগ পর্যন্ত তার মনে যে সাহস ছিলো তা নিমিষেই হারিয়ে গেলো। একটা সত্যের সাথে হাজারো মিথ্যা এসে সমাজের পাতায় তাদেরকে কলংক লেপন করবে।
এটা নিয়ে সে ভাবতে বাধ্য হয়েছিলো।
অভিমানের দেয়ালটি আর ভাঙা হলো না। প্রিয়ন্তী বসে পড়লো নব বধুর সাজে। প্রিয়জন হারানোর এই রঙিন আয়োজন ইমনের কাছে সূর্যের আলোতে চিকচিক করা ধারালো ছুরির মতো মনে হলো। মনে হলো কেউ যেন খুব আস্তে করে খুব ধারালো ছুরি দিয়ে তার হৃদয়টা কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
সেদিনের পর সমাজ জেনেছিলো। জেনেছিলো প্রিয়ন্তী আর ইমনের পরিবার। দুটি হৃদয় দুই পাত্রে থাকায় তারা সারা জীবন এক হয়ে থাকতে পারেনি।
অভিমানের দেয়ালকে সামনে রেখে প্রিয়ন্তী সুখেই কাটাতে থাকলো তার স্বামীর সংসারে।
এজন্য কেউ বলে নারী একদিকে যেমন মমতাময়ী অন্য দিকে ততটায় কঠোর।
এদিকে ইমন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছেনা। হাসি মাখা মুখটা আর রইলো না।
একদিন ইমনের বাবা এসে বলল চল গ্রামে বেড়াতে যাব। ইমন চমকে উঠলো গ্রামে কেন?
ইমনের বাবা বলল : অনেক দিন আগে তোমার দাদা তোমার দাদার ভাইয়ের সাথে অভিমান করে শহরে চলে এসেছিলো। তখন আমরা ছোট। সেদিন থেকে আমাদের গ্রামের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তোমাদেরকেও বলা হয়নি।
কিছুদিন আগে তোমার ওই দাদার ছোট ছেলে ফোন করেছিলো।বহু কষ্টে সে আমার নাম্বার জোগাড় করেছে। সে এখন গ্রামের একটি স্কুলে চাকরি করে। গতকাল সে আমাদের বাসায় এসেছিলো। বাবার সব অভিমান ভাঙিয়ে গেছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবাই এক সাথে গ্রামে বেড়াতে যাব।
সব শুনে ইমন বুঝতে পারলো সেদিনের টিভি নিউজে তার মর্মাহত হওয়ার কারণ।
পর দিন সকলে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
যেতে যেতে ইমন ভাবতে থাকলো, দাদার অভিমানের চেয়েও কি প্রিয়ন্তীর অভিমান বেশি? সে কি অভিমানটা সিরিয়াসলি করেছে?
আমার সিরিয়াসের অধ্যায় সমাপ্ত করে সেই সিরিয়াস হয়ে গেল!!!
পোষ্ট সংগ্রহকৃত
Comments
Post a Comment